রাত্রি শেষে প্রিয়তম বলল— “এবার আসি আমি? এবার বিদায় দাও?”
আমি শুনেও না শোনার ভান করলাম— “বিয়ার শেষ। আরো আনি?”
সেই চোখের হাঁসি— “যেতে দেবে না আমায়? দেবে না বিদায়?”
আমার অভিমান জাগানো তার খুবই শখের, বললাম— “কেন দেবো?”
—”এই যে, এই জীবনসাগরের তটে আজও—আজও আমাদের সেই দুই চেয়ার পাতা আছে—এইটা তোর আরেকটা আমার, সেই কোন এই অতীতে পেতে রেখে গেছিলিস। চেয়ার দুটো আজও আমাদের অপেক্ষা করে, সেই মুহুর্ত্তকে অমর করার প্রয়াসে। আজ এসছিস, তাও বা এই কল্পমূর্ত্তি ধরে, এলি তাও দিনের শেষে, সূর্য্য যখন ঢলেছে। আবার চাইছিস বিদায়? এত তাড়া তোর?”
—”সূর্য্যের আলোতে কেমন লাগছিল, বল? হালকা গরম জলের ঢেউ—ঠিক তোর আদরের মতন! শুধুই ডুবিয়ে দেওয়ার ধান্দায়!—গায়ে লেগে থাকা বালি যেন সোনার চূর্ণ—”
—”আমি-ই তো সেই গোঁয়ার বালি—ঝাড়লেও যেতে চাই না, সব ওঝার উর্দ্ধে, প্রেমের আলিঙ্গন হয়ে লেগে থাকি, কতযুগের প্রত্যাশিত আলিঙ্গন, আজ এক লহমায় আন্দোলনে ফেটে পড়েছে—তোমার পদতলে, তোমারই ভক্ত চিরতরে—”
—”এত প্রেম, হায়, আমি কোথা রাখি, নাথ? যেতে দে না রে এবার!”
আমার চোখে অলক্ষ্য বেদনার জোয়ার উঠল। বুকে যেন এক বিশ্বভার এসে নামল।
—”কি করে দিই বলো? তুমি তো সেই চিরন্তন স্মৃতি, সেই চির আশ্রয়, আমার প্রাণের বাসঘর। তুমি যদি বিদায় নাও, এই প্রাণ আর বাস বাঁধিবে কোথায়? খাঁচা যে রইবে না আর—উদ্বাস্তু হবে এই আত্মা। দেহও যেমন যাযাবর, এবার আত্মাও তাই—এই ঢেউয়েই মিশে থাকবে, কত গভীরে তলিয়ে গিয়েও, এই তীরের উপর আছড়ে পড়ে তোকে খুঁজবো, তোর সোনালি পায়ের স্পর্শের আশায়—খুঁজব এই আমাদের ক্ষুদ্র মুহুর্ত্ত, কোন অতীতে হারানো—খুঁজে পাওয়ার আশা আর থাকবে না, তাও খুঁজে যাবো, উন্মাদের মতন—”
—”তোকে বলেছি, না? এরকম কথা না বলতে? চুপ কর!”
ও যেমন আমার অভিমান জাগাতে পারে, পারি আমিও তেমন ওকে উত্যক্ত করতে।
—”পাগলের প্রলাপ বকছিস! তোকে নিয়ে আর পারি না!”
—”পাগলই তো! দেখই না! তোর কল্পময় কায়ের সান্নিধ্যে কি উল্লাস আমার, জেনেও যে তুই কেবলই কল্পমাত্র! দেখেছিস সেই পাষাণমূর্ত্তির সেবা? যে পাথরের চোখে নেই মায়া, নেই দয়া—তার গলায় মালা দিয়ে সেই মূর্খ পাগলের ভক্তি! দেখিসনি?! কোন এক ক্ষুদ্র মানবকায়ে আত্মভূলে ভগবান বসিয়ে, ভগবান ভেবে সেই জ্ঞানহারা অনন্তর স্মরণ করে চলে—সে পাথর কি আর উত্তর দেবে? যতই না অশ্রজলের অভিষেক করাস, যতই না প্রেমের নৈবেদ্য সাজাস—সে নেই রে, সে ভগবান নেই রে পাথরে—”
প্রিয়তম মৃদুলজ্জিত হাঁসিতে মুখ ঘোরায়।
—”কোনদিকে না চেয়ে একমনে একাগ্রচিত্তে শুধু তোকেই মনের সিংহাসনে বসিয়ে ভজনা করেছি—সেই ত্যাগ তুই বুঝিস?”
বুঝদার হাঁসি দিয়ে প্রিয়তম বলল— “না, আমি অত বুঝিনা!”
—”আজও সে অনড়—তোকে হৃদয়াকাশে ধ্রুবতারা করে রেখেছে—দেশে-বিদেশে যেখানেই যাক না কেন, তোর স্মৃতি-ই সেই চিরন্তন আশ্রয়—পাগলই তো সে রে, যে পাথরকে মানুষ না করে মানুষকেই পাথর করে দিয়েছে—মানুষকে ভালোবাসতে গিয়ে দেবতা বানিয়েছে—এই ভূলে গিয়ে যে দেবতারা মানুষ নয়, অমানুষ! অমানুষের মতন ভালোবেসেছি তোকে!
—”তবে ভূলে যা, না! কেন মনে রেখেছিস?!”
—”চেষ্টা করিনি আর?! কতবার মনের মধ্যে ফাঁস বেঁধেছি, কতবার রক্তবীজ হয়ে ঝরিয়েছি রুধি! করালবদনা কালির আর পান করার ক্ষমতা নেই। দেহ থেকে প্রত্যেকটি ঝরে যাওয়া রক্তবিন্দুকে আদেশ দিয়েছি—মুক্তি দাও, মুক্তি দাও আমারে, এই প্রেমিকের বিষ হতে, এই স্মৃতি মুছে দাও—পারেনি, পারেনি তারা! অভাগা আমি! তুই প্রাণে বিদ্ধ—একদিন সেই চিতাতেই মুক্তি পাবো, হে কল্পময়, সেই দিন—সেই মুক্তির ধূমে আমরা কল্পনা হয়ে যাবো দুজনেই!”
—”আবার?! এরকম কথা ভালো লাগে না। আজ থাক, বাবু। আজ না, আবার অন্য দিন আমরা বসবো আমাদের এই চেয়ারে, কেমন?”
—”বলি, কোথায়ই বা যাবি তুই? কিসের তাড়া তোর?”
—”ওই দেখ পুবে! ভোর হচ্ছে!”
—”তো?”
—”ওপরে দেখ—”
—”কি দেখবো?”
—”কোটি কোটি তারা দেখ, আমাদেরই কল্পের বীজ!”
—”আমাদের কল্পের বীজ মানে?”
—”হ্যাঁ রে, এই মণ্ডলেই সাজানো আমাদের প্রত্যেক কাহিনী, প্রত্যেক জনমের, প্রত্যেক কল্পের—যা ছিলাম আমরা, যা আছি, যা নেই—আর যা হতে পারতাম—সব সাজানো আছে।”
—”সব আমাদেরই কল্প?”
—”সবই। দেখ, কেমন অনন্তপটে অঙ্কিত!”
—”অনন্তের বিদায় হয়? তখন থেকে যে বিদায় বিদায় করে নাচছিস?”
—”হয় তো! সূর্যকিরণে সব লয় পায়, সব হারিয়ে যায় দিবসের নৈরাজ্যে!”
—”ফিরেও তো আসে! সত্যি করে কি আর লয় পায়?”
—”থেকেও থাকে না, আবার না থেকেও থেকে যায়– আমার কল্পমূর্ত্তি তেমনই।”
খেয়াল করিনি। আসন্ন ঊষায় তার মূর্ত্তিও কেমন জানি আবছা হয়ে গেছে। অন্যমনস্ক হয়ে গুনগুন করে গাইতে গাইতে পশ্চিমের দিকে এগোচ্ছিল। আতঙ্কিত হয়েই ডেকে ফেললাম।
—”দাঁড়া।”
শ্বাস যেন আটকে এলো, আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে। আরো জোরে বললাম।
—”দাঁড়া!”
ফিরে তাকাল।
—”একটি পুত্র গ্রহণ করেছি, নাম ঈশান। তোর সঙ্গে আলাপ হল না যে।”
—”সে তো আমারও। তোর পুত্রের দেহে যে রক্ত বইছে, বইছে যে স্নেহসান্দ্রতা, তাতে কি আর তোর একার স্নেহ আছে? মাঝে মাঝে খুব ক্যাবলা ক্যাবলা কথা বলিস!”
—”দেখা করবি না একবারও? আসবি না আমাদের কাছে?”
—”আলাপ হবে না হয়তো— আমার মূর্ত্তি তো কল্পের মাত্র, তার কাছে তো অদৃশ্য— কিন্তু তোর মধ্যে দিয়েই চিনবে আমাকে, জানবে— জানবে আমাদের প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ—তুই কিন্তু আমার হয়েও ভালোবাসিস ওকে, ডবল স্নেহ পায় যেন ঈশান—তোর আর আমার প্রাণ ওর দেহে সমবিত, দুই বাপের প্রেম ওর হৃদয়েই অমর রয়ে যাবে— আর একদিন রচবে আমাদের মহাকাব্য—কবিকুলের ছেলে বলে কথা—”
—”সে তো লিখবেই, আর আমি বুঝি এই কল্পেই বন্দি রইবো?”
—”বেঁধে রাখলাম তোকে, পাছে কেউ নিয়ে নেয়।”
—”তাই বলে এই শাস্তি? এই তোর প্রেমের অভিচার?”
—”তুইও যেমন ভুগতে ভালোবাসিস! পাগল তো! এত কোটি দেবতা থাকতেও তিনি নাকি এক ঈশ্বরের ভজনা করেন! এসব কি আর এ যুগে হয়?”
—”বুঝিস না, নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করিস?”
—”বলবো না, যা! চললাম আমি! আর কাঁদবি না একদম—মনে রাখবি অদৃশ্য হলেও যেমন তারা আছে, তেমন আমিও আছি।”
—”শত কোটি তারার মধ্যে আর হারিয়ে কি হবে? জানিস না, তান্ত্রিকরা বলে তারার ২১ বিভূতি, কিন্তু তারিণী-তারা অদ্বিতীয়া— সেই ধ্রুবা! সেই ধ্রুবতারাই আমার জন্যে যথেষ্ট।”
—”প্রণাম তোকে, তর্কের ধানি লঙ্কা তুই— তর্কে তোর সাথে পারা যাবে না! আমি যাই!”
মায়াবী মূর্ত্তি তখন আর নেই। তারার সাথে সাথে সেও অদৃশ্য। হিরণ্ময় রথারোহী সবিতার আগমনী গাইছিল ভোরের বাতাস। উপাংশু জপে রত সমুদ্রের ঢেউ। দীর্ঘনিঃশ্বাসে শোকের অঘমর্ষণে, সেই মুহুর্তের আন্তরিকতায় আমি ঘুরে তাকালাম পুবদিকে। এক লহমায় দেখলাম যেন তারই অন্য প্রাচীনতম মূর্ত্তি—এক পলকেই যেন ফেটে পড়ল সূর্যোদয়—সব কল্প ভেদ করে—ভাঙ্গলো মুক্তি!
চিরসখা স্মরণে—
বৈশাখ অমাবস্যার ঘোর আঁধারে,
The 23rd of April in 2020 CE.